
এক সময়ের অবহেলিত কাঁকড়া ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। দেশ বিদেশে বাড়ছে কাঁকড়ার চাহিদা। সেকেলের সনাতনী পদ্ধতিকে পেছনে ফেলে উন্নত প্রযুক্তিতে উৎপাদন হচ্ছে কাঁকড়া। জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত কাঁকড়া এখন রপ্তানী হচ্ছে বিশ্বের অন্তত বিশটি দেশে। নতুন এখাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি বেকারদের কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজারের কাঁকড়ার সুখ্যাতি। ইতিমধ্যে ‘ইরাওয়ান ট্রেডিং’ নামে কাঁকড়া উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় মৎস্য পুরস্কার-২০১৬ জিতেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক অংছিনকে পুরস্কার হিসেবে স্বর্ণ পদক ও ৫০ হাজার টাকার চেক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
কক্সবাজার সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ড. মঈন উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নরম কোলস বিশিষ্ট কাঁকড়া উৎপাদন করে অংছিন। তার দেখাদেখি উৎসাহিত হয়ে জেলায় শতাধিক ব্যক্তি কাঁকড়া চাষ শুরু করছেন। কক্সবাজারের কাঁকড়া চাষীরা নিয়মিত প্রায় ২০টি দেশে কাঁকড়া রপ্তানী করছে। দেখাদেখি অনেকেই এখন বাণিজ্যিক কাঁকড়া চাষে উদ্যোগি হয়েছেন।’
সুত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের দিকে প্রথম কাঁকড়ার পোনা ও চাষ বিষয়ে গবেষনা কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষনা ইনষ্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য প্রযুক্তি কেন্দ্র। এরপর ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে ও আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষনা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ’র এ্যাকুয়াকালচার ফর ইনকাম এন্ড নিউট্রিশন প্রকল্পের যৌথ তত্ত¡াবধানে কক্সবাজারের একটি হ্যাচারীতে নতুন উদ্যোগে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে নিবিড় গবেষনা কার্যক্রম গ্রহন করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন এলাকায় সফটসেল (আধুনিক) ও সনাতন পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছরা, সদরের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডি, গোমাতলী, টেকনাফের লেদা, চকরিয়ার বদরখালী, রামপুর, ডুলাহাজারা, মহেশখালীর সোনাদিয়া ও মাতারবাড়ী। সনাতন পদ্ধতির কাঁকড়া চাষের মৌসুম মে থেকে ডিসেম্বর। আধুনিক পদ্ধতির কাঁকড়া চাষ সারা বছরই হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ সহায়তা পেলে চিংড়িখাত দেশের অন্যতম একটি রপ্তানীখাতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
সদরের খুরুশকুলের ‘সফটসেল’ পদ্ধতির একটি প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, কাঁকড়া চাষের জন্য বাঁশ ও রশি দিয়ে এখানে তৈরী করা হয়েছে মাচা। কিছুদূর পর পর সবুজ টিনের ছাউনি দিয়ে বানানো হয়েছে কিছু বাসা। এসব বাসার মধ্যে মজুদ করা হয়েছে কাঁকড়া চাষের সরঞ্জামাদি। ছোট ছোট করে তৈরী করা হয়েছে পুকুরগুলো। পুকুরের পানির উপরে বসানো হয়েছে বাঁশ ও প্লাস্টিকের নেট। নেটের ভেতরেই রাখা হয়েছে বাচ্চা কাঁকড়া। নির্দিষ্ট সময়ের পরে এসব কাঁকড়া খোলস বদলালে তাদের ধরে পুকুরে দেয়া হয় বলে জানান চাষিরা।
কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নের উপক‚লীয় গ্রাম মনুপাড়ায় ৩ একর জমিতে গড়ে তুলা হয় ‘ইরাওয়ান ট্রেডিং’ নামে কাঁকড়া উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সাল থেকে তীলে তীলে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেন অংছিন। ২০১৫ সালে অংছিনের মালিকানাধীন কাঁকড়া উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইরাওয়ান ট্রেডিং’ ৩০ মেট্রিক টন কাঁকড়া রপ্তানী করেছে। ওই খাতে আয় হয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। মিলেছে কাজের স্বীকৃতিও। প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতেই এই প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ও ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেন।
সফল কাঁকড়া চাষি অংছিন বলেন, ‘নিজের সঞ্চিত অর্থ ও বন্ধুবান্ধবদের থেকে ধার নিয়ে প্রথমে ৪০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। ওই বছর মৎস্য বিভাগের সহায়তা নিয়ে বিদেশে কাঁকড়া রপ্তানী করার সুযোগ পাই। আর পেছনে তাকাতে হয়নি।’ তিনি জানায়, খামারে ৩০ থেকে ৪০ জনের নিয়মিত কাজ করে। তাছাড়া ৮০ থেকে ১০০ জনের পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। তাঁর প্রকল্প এলাকায় ৫০ হাজার বক্স রয়েছে। প্রতিটি বক্সে একটি করে কাঁকড়া উৎপাদন হচ্ছে। ইউরোপ, অস্টেলিয়া ও আমেরিকায় তাঁর কাঁকড়া রপ্তানী ব্যবসাকে আরো স¤প্রসারিত করতে চান অংছিন।
বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নে তাঁর ৩ একর আয়তনের আরেকটি কাঁকড়া চাষের খামার রয়েছে। সেখানেও উৎপাদন হচ্ছে নরম খোসার কাঁকড়া।
জেলায় সনাতন ও ‘সফটসেল’ তথা আধুনিক পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতির চাষ বহু পুরানা হলেও ২/৩ বছর আগে থেকে ‘সফটসেল’ পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। ইদানিং সরকারীভাবে বড় ধরণের ‘কাঁকড়া ও কুচিয়া প্রকল্প’ আসছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি ও স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক বলে উপকুলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাঁকড়া চাষের ফø্যাশব্যাক:
স্বাধীনতাপরর্বতী সময়কাল থেকে বাংলাদেশে বানিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকায় চিংড়ি/মৎস্য ঘেরের প্রধান ফসল বাগদা চিংড়ি হলেও সাথী ফসল হিসাবে ঘেরে যৎসামান্য কাঁকড়া উৎপাদিত হত। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কাঁকড়া না খাওয়ায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাই ছিল এর প্রধান ভোক্তা। তাই চাহিদা কম থাকায় কাঁকড়ার বাণিজ্যিক উৎপাদন ছিলনা বললেই চলে। এ অবস্থা চলে নব্বই দশক পর্যন্ত।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে উদ্যোগী কতিপয় ব্যাবসায়ী থাইল্যান্ড, কেরিয়া, চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানসহ মঙ্গোলিয়ান বেল্টের দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিসরে কাঁকড়া রপ্তানি শুরু করেন। পরবর্তীকালে কাঁকড়ার চাহিদা বৃদ্ধি পেলে বানিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সীমিত আকারের চাষ থেকে উৎপাদিত কাঁকড়া বিগত বছর গুলোতে ৫ থেকে ৭ হাজার টন প্রতি বছর রপ্তানি হয়। সে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে চাষের পরিধি ও রপ্তানী। বর্তমানে কাঁকড়া চাষ একটি সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিনত হয়েছে।
কক্সবাজার মৎস্য অফিস জানায়, বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকায় পাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে মাড ক্রাব বা শীলা কাঁকড়ার দাম ও চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশী। তাই কাঁকড়া চাষ ও ফ্যাটেনিং দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চিংড়ি চাষে ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি থাকলেও কাঁকড়া চাষে এ ঝুঁকি নেই।
কাঁকড়া প্রজাতিগত ভাবেই দ্রæত বর্ধনশীল। যে সব অপরিপক্ক কাঁকড়া (স্ত্রী ১৭০ ও পুরুষ ৪০০ গ্রামের কম) রপ্তানীযোগ্য নয় বলে বাজারে বা ডিপোতে বিক্রি হয়না, সে সব কাঁকড়া উপযুক্ত পরিবেশে ২-৪ সপ্তাহ লালন পালন করে পরিপক্ক বা মোটা তাজা করাকে ফ্যাটেনিং বলা হয়।
হ্যাচারীতে বানিজ্যিক ভাবে কাঁকড়া পোনা উৎপাদন অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি। এর প্রয়োগ ও উৎপাদনে মূল বাধা কাঁকড়া পোনার বাঁচার হার। পরিপক্ক মা কাঁকড়ার ডিম দেয়ার হার আশি হাজার থেকে চল্লিশ লক্ষ হলেও পোনার বাঁচার হার মাত্র এর দশ ভাগ।
সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং ওয়ার্ল্ডফিশ এর যৌথ গবেষনা ও পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে, হ্যাচারীতে প্রথম পর্যায়ে (ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে) ৪ টি পরিপক্ক মা কাঁকড়া থেকে যথাক্রমে ৩২ লক্ষ, ১৬ লক্ষ, ২৬ লক্ষ ও ১২ লক্ষ জুইয়া (ডিম থেকে বের হওয়া পোনার প্রথম ধাপ) পাওয়া গেছে। মা কাঁকড়া থেকে পুর্নাঙ্গ পোনা মোট ৬টি ধাপ পার হয় (জুইয়া থেকে মেগালোপা)।
বাংলাদেশ ইতিপুর্বের সব গবেষনায় মা কাঁকড়ার হ্যাচিং এর তথ্য পাওয়া গেলেও জুইয়া ধাপ পার হওয়ার নজির নেই। কিন্তু সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং ওয়ার্ল্ড ফিসর যৌথ গবেষনায় প্রজননকৃত কাঁকড়া থেকে সব ধাপ পার হয়ে পুর্নাঙ্গ কাঁকড়া উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। প্রনোদিত উপায়ে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনও সম্ভব হয়েছে। প্রনোদিত উপায়ে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনে বাংলাদেশে এটিই সর্ব প্রথম সফলতা। এতে কাঁকড়া পোনার বাচার হার প্রায় ১.৫ ভাগ পাওয়া যায়। এ গবেষনায় উৎপাদিত পোনা গবেষনাগারে লালনের পর পুকুরে মজুদ করা হয়েছে।
হ্যাচারীতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে পানি বিশুদ্ধকরন, পানি ও খাদ্যের গুনগত মান রক্ষা, রোগ-বালাই প্রতিরোধ ও সর্রোপরি খাদ্য হিসাবে আনুবিক্ষনিক খাদ্য সরবরাহ ব্যাবস্থাপনা গুরুত্বপুর্ন। কাঁকড়া পোনা লালনের জন্য ওয়ার্ল্ডফিস এর সহায়তায় ইতিমধ্যে সামুদ্রিক মৎস্যও প্রযুক্তি কেন্দ্রে এলআরটি স্থাপন করা হয়েছে।
কাঁকড়া চাষি ইশতিয়াক আহমদ জয় জানান, কক্সবাজারের হ্যাচারীতে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনের সফলতা অনেক শিল্প উদ্যোক্তাকে আগ্রহী করে তুলবে। নব্বই দশক থেকে এ পর্যন্ত কক্সবাজারের উপকুলীয় অঞ্চলে বাগদা চিংড়ি হ্যাচারী শিল্পের ক্রমবিকাশের দিকে তাকালে আমরা যেন এ বার্তাই শুনতে পাই ।
তিনি বলেন, বাগদা চিংড়ি হ্যাচারী শিল্প থেকে এখন প্রতিবছর ১ হাজার কোটি চিংড়ি পোনা উৎপাদন হচ্ছে। দেশের আভন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে এসব পোনা বিদেশে রপ্তানীর নজিরও রয়েছে। বাগদা চিংড়ি হ্যাচারী শিল্পের দেখানো পথ ধরে হয়ত কক্সবাজারে কাঁকড়া হ্যাচারী শিল্পেরও স্থানীয়করন হবে।
তার মতে, কাঁকড়া হ্যাচারীতে পোনার সহজ প্রাপ্যতা কক্সবাজার অঞ্চলে বিকাশমান কাঁকড়া চাষকে সম্প্রসারিত করবে। উপকুলীয় অঞ্চলে উৎপাদিত কাঁকড়া তখন মুল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হবে। কারন, আর্ন্তজাতিক বাজারে চিংড়ির পরেই কাঁকড়ার স্থান।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন বলেন, সরকার কক্সবাজার ও খুলনা অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ স¤প্রসারনের জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন করেছে। কাঁকড়া পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যাপকভাবে স¤প্রসারন হলে উৎপাদিত কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের এই অন্যতম রপ্তানি পণ্য কাঁকড়ার প্রধান উৎপাদন এলাকা হবে কক্সবাজার জেলা। আমরা সেই উজ্জল নব ভবিষতের অপেক্ষায় আছি।
তিনি আরো বলেন, ‘কাঁকড়া চাষ’ প্রকল্প নিয়ে নতুন করে ভাবছি। বেসরকারী উদ্যোক্তাদের সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে ‘কাকড়া চাষ’কে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।
অমিতোষ সেন বলেন, ‘কাঁকড়া চাষে ঝুঁকি না থাকায় সফলতা বেশি। আগে মানসম্মত কাঁকড়া চাষের জন্য বিদেশ থেকে প্লাস্টিকের ঝুঁড়ি আনা হতো। এতে প্রতিটি ঝুঁড়ির পেছনে ব্যয় হতো ১৩০ টাকা করে। এখন দেশেই এসব ঝুঁড়ি তৈরি হচ্ছে। মাত্র ৩০ টাকায় ঝুঁড়ি পাচ্ছে কাঁকড়া চাষিরা। তিনি জানান, সারাদেশ থেকে কাঁকড়া ও কুচিয়া রপ্তানী করে গত বছর ২০১৫ সালে ১৯৯.৩৮ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে বাংলাদেশ।
পাঠকের মতামত